Skip to main content

বাংলা গানের তিন তুক কাঠামোকে ভাঙলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জর্জ বিশ্বাসের গান নিয়ে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অভিযোগের কেন্দ্রে ছিল গানের প্রিলিউড ও ইন্টারলিউডে যন্ত্র ও সুরের ব্যবহার। তাঁর গাওয়া কিছু গানে এইসব ক্ষেত্রে যন্ত্রের বাদনভঙ্গিমা নাকি গানের কথা ও ভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এইই ছিল তাঁদের অভিমত। রবীন্দ্রনাথের গানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল, তাঁর পূর্বতন সময়ের বাংলা গানের তিন তুক (স্থায়ী-অন্তরা-আভোগ)-এর কাঠামো ভেঙে তিনি প্রথম বাংলা গানের শরীরে যোগ করলেন একটা নতুন স্তবক – যার নাম সঞ্চারী। এই সংযোগের পেছনে একটি সচেতন ভাবনা রয়েছে যার কথা তিনি বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন তাঁর ‘সংগীতচিন্তা’য়। তত্ত্বগতভাবে তিনি মনে করতেন গানের বাণী ও তার অন্তর্গত ভাবের হাত ধরেই গড়ে উঠবে গানের সুরের চলন আর গানের সেই কাব্যগর্ভা আদল তার গভীর ও অনিঃশেষ ব্যাঞ্জনা নিয়ে বেজে চলবে শ্রোতার মনে। এই ভাবনা থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তিনি গানের সুর তৈরি করেছেন প্রথাগত শাস্ত্রীয় ব্যাকরণকে অস্বীকার করে। আর গানের সঞ্চারী সেই ভাবপ্রকাশ ও বিস্তারের এক অনিবার্য মাধ্যম হয়ে দেখা দেয় তাঁর গানে। বস্তুতপক্ষে চারতুকের গানে ওই সঞ্চারী অংশটি মূল গানের ভাবটিকে রসোত্তীর্ণ করার এক আশ্চর্য জাদুকাঠি।  এখন চার পর্বে বিন্যস্ত এই গান কীভাবে গাওয়া হবে? একটানা ? নাকি কিছুটা যতি দিয়ে? মূলত এই জিজ্ঞাসা থেকেই গানের প্রিলিউড ও ইন্টারলিউড এর প্রসঙ্গ উঠে আসে। আর সমস্যাটা আরও জটিল হয় কেননা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়েও কোনও নির্দেশ দিয়ে যাননি। কিছু গানের স্বরলিপিতে এই পর্যন্ত নির্দেশ আছে যে স্থায়ী থেকে অন্তরা হয়ে সঞ্চারীতে যাওয়ার আগে হয়তো আবার স্থায়ী ছুঁয়ে যেতে হবে, কোথাও বলা হয়েছে অন্তরা দুবার করে গেয়ে সঞ্চারীতে যাওয়ার কথা, কখনো সঞ্চারী দুবার গেয়ে আভোগে যেতে হয়। কিন্তু এই চলাচলগুলো মেনে নিলেও এই পুরোটা কি একবারে টানা গাওয়া হবে? কবি নিজে যখন নিজের গান গাইতেন তিনি পুরো গানটাই একসঙ্গে গেয়ে যেতেন। তাঁর গাওয়া কয়েকটি গান গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করেছিলেন, সেখানেও একই ধরন আমরা দেখি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য-ধন্যা যাঁরা তাঁর কাছেই গানের শিক্ষা নিয়েছেন তাঁরা তাঁদের প্রথম দিকের রেকর্ডে কবিগুরু প্রবর্তিত রীতিই অনুসরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে প্রকাশ্য মঞ্চ-অনুষ্ঠান তখন প্রচলিত ছিল না, যা হত সবটাই শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দির ভেতর – হয়তো সেখানেও এই একই রীতি মানা হত।  শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের বাইরে যেসব শিল্পীদের গান গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করেছেন সেখানে আমরা দেখব মূলত দুটি প্রথা অনুসরণ করা হয়েছে এই বিষয়ে। প্রথমটি হল, গান শুরুর মুখে গানের স্থায়ীর সুরটা দু/তিনবার বাজিয়ে নিয়ে গানের সূত্রপাত, তারপর গোটা গানটি গেয়ে আবার স্থায়ীতে ফিরে গানের সমাপন। দ্বিতীয়টা হল, গোড়ায় স্থায়ীর সুর বাজিয়ে গান শুরু করা, তারপর অন্তরা থেকে সঞ্চারীতে যাওয়ার আগে একটু যতি, সেখানে স্থায়ীর সুরটিকে দু/তিনবার যন্ত্রে বাজিয়ে নিয়ে সঞ্চারী ও আভোগ একসঙ্গে গেয়ে স্থায়ীতে ফিরে আসা। খেয়াল করলে দেখা যাবে দীর্ঘদিন যারা সুনামের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন তাঁরা এই দুই প্রথাই মেনেছেন।  এখানে বলা দরকার, গানের মধ্যে গায়কের কণ্ঠকে সামান্য বিশ্রাম দেওয়ার জন্যই ইন্টারলিউডের প্রচলন হয়েছিল বলে ধরা যায়, এখানে কবির নির্দেশ কিছু নেই। আর সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথের গানে সঞ্চারীতে সুর অনেকটা খাদের দিকে নেমে আসে, কণ্ঠকে ওই খাদের দিক থেকে সুরে লাগানোর আগে স্বল্প বিরাম দিলে তা সাধারণ গায়কের পক্ষে স্বস্তি। তবে কোনও সক্ষম কণ্ঠ যদি পুরো গান একটানা গেয়ে যান তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু, ধারাবাহিকভাবে গানের মধ্যে কথা ও সুরের বৌদ্ধিক ব্যাঞ্জনা ফুটিয়ে তোলার জন্য ইন্টারলিউডের প্রয়োজন আছে। কারণ তাঁর অসংখ্য গানে অন্তরা থেকে সঞ্চারীতে পৌঁছে গানটির ভাবগত উত্তরণ ঘটে – সেই উত্তরণের পথটাকে কিছুটা স্পষ্ট করার জন্য একটা ধরতাই সুরের প্রলেপ ও আবহ বাঞ্ছিত। আর দীক্ষিত শ্রোতার পক্ষেও এটা প্রয়োজন, এটা তাঁর একরকম প্রস্তুতির অবসর যেটা পেলে তিনি ছুঁতে পারেন উড়াল দেওয়া গানের পাখাটিকে। পাশাপাশি খেয়াল করা দরকার, আদিকালের রেকর্ডিং প্রযুক্তিতে কিন্তু তিন মিনিট সময়সীমার মধ্যে গানের রেকর্ডিং সীমাবদ্ধ রাখতে হত। সেই আটাত্তর আর পি এম এর গালার রেকর্ড থেকেই এর সূত্রপাত, পরে এক্সটেন্ডেড প্লেয়িং (ই পি) বা লং প্লেয়িং (এল পি) এ গানের সংখ্যা বাড়লেও প্রতিটি গানের সময়সীমা তিন মিনিট সময়সীমা ছাড়ায়নি। এই সীমাবদ্ধতার কারণে অবশ্যই প্রয়োজন হয়ে পড়ল গানের প্রিলিউড ও ইন্টারলিউডের একটা পরিমিতি যাতে সবটুকু নিয়েই গানের গায়ন সীমা তিন মিনিটে বেঁধে রাখা যায়। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিতে এই সীমাবদ্ধতা আর নেই। কারণ, ডিজিটাল রেকর্ডিং ব্যবস্থায় যন্ত্রানুষঙ্গ সমেত পাঁচ বা ছয় মিনিট কেন একটানা গান রেকর্ড করার কোনও অসুবিধা নেই ও সময়ের নিখুঁত হিসেব কম্পিউটার মনিটরে দেখে নেওয়া যায়, ট্র্যাক কেটে ছেঁটে সময়ের এদিক ওদিক করা যায় অনায়াসেই – কিন্তু হচ্ছেটা কী? প্রিলিউড ও ইন্টারলিউডের ক্ষেত্রে যে প্রথা এতদিন মেনে চলা হয়েছে - অর্থাৎ, শুরুতে স্থায়ীর সুর ও ইন্টারলিউডে তারই একটা রেশ রেখে সঞ্চারীতে যাওয়া, দেবব্রত বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এই প্রথার ব্যাত্যয় ছিল না। কেবলমাত্র ওই ছোট্ট পরিসরে বাজানো হয়েছিল একাধিক যন্ত্র, যা কারোর কারোর মনে হয়েছিল বেসুরো বা বেমানান। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তিতে এক মিনিট/ দেড় মিনিট বা তারও বেশি প্রিলিউড বা ইন্টারলিউড বাজানো যায়। তার মানে এটা একটা সম্ভাবনা। গানের কথার সঙ্গে সংগতি রেখে তৈরি করা যায় প্রিলিউড বা ইন্টারলিউড যা আরও একটু ছড়িয়ে ধরতে পারে গানটিকে, শ্রোতার কানে আরও একটু ঘন আবহ তৈরি করতে পারে সেই সুর। এই সুযোগ বিস্তৃততর, কারণ, প্রযুক্তির সাহায্যে যে কোনও ধরনের তাল বা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা যায় অবাধে। সাম্প্রতিককালে গানের রেকর্ডিং এর ক্ষেত্রে অ্যারেঞ্জার নামক একটি ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে যিনি সংগীতপ্রযুক্তির সহায়তায় আলাদা করে প্রিলিউড বা ইন্টারলিউডের ট্র্যাক তৈরি করে দেন। অপার একটা সম্ভাবনার দিগন্ত যার ভিতর সৃজনের স্বর বুনন করা যায়। অ্যারেঞ্জারের বানানো ট্র্যাকের ওপর শিল্পীর কন্ঠ রেকর্ডিং হয়।  তারপর শুরু হয় মিক্সিং। হামানদিস্তের বদলে মিক্সিং। হাল আমলের যে কোনও শিল্পীর গান, অন্তত যারা ডিজিটাল রেকর্ডিং প্রজন্মের শিল্পী, শুনে দেখছি, পাঁচ/ছয় মিনিটের গানে প্রায় তিন মিনিট বরাদ্দ রয়েছে প্রিলিউড ও ইন্টারলিউড এর জন্যে। আর, অত্যন্ত দায়িত্বের সঙ্গেই বলতে চাই, কিছু ক্ষেত্রে গানের প্রিলিউড বা ইন্টারলিউড যদি আলাদা করে শোনা যায়, তা যে আসলে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনও ধরতাই সুর তার হদিশ পাওয়া কঠিন শুধু নয়, অসম্ভব। অবশ্য কেউ বলতেই পারেন, এও তো সাবজেক্টিভ! হ্যাঁ অবশ্যই সাবজেক্টিভ। কিন্তু কান বলে একটা ইন্দ্রিয় আছে যেটা ছাড়া গান গাওয়াও যায় না, শেখাও যায় না। ওইসব সুরের সামনে বসে কান বিদ্রোহ করে অথবা বিষাদে ছেয়ে আসে। ভাগ্যিস, বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির আগেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে! নতুবা আজ তাঁরা অপঘাতে মরতেন!! 
 

Comments

Popular posts from this blog

Death of the Renaissance Man and the Lost Soul of Harvard

I was born in Assissi, spent my childhood in Florence, spent time in Jerusalem and Jeddah and moved to Aix-en-provence. I was a apprentice at the Abbaye Notre-Dame de Senanque for few years before crossing the Atlantic for postgraduate studies in Classical, Medieval and Renaissance studies. In the Nineteenth century and the early 20th century, until the 1950s, Harvard University used to be an elitist conservative, vintage university of New England for Boston brahmins many of whom have their origins in the Puritan times of John Winthrop. They held dearly European values and created a New England out of their own culture that epitomozed John Harvard's Harvard University. However, since the 1960s, Harvard has become over liberalized like the University of California Berkeley, embracing a counter European culture and deconstruction by embracing wholesale multiculturalism and putting in leadership position people of non-western origin who lack western and European values. How and w...

Prairie Song — A Day from My Heart’s Almanac

Dawn breaks like a hymn over the hills. The rooster crows and the golden light creeps through gingham curtains. Laura’s already up, kneading dough with gentle hands, flour dusting her apron like snow. Michael’s chopping wood out back—his laughter rising with the crack of the axe, telling a story to the youngest as the dog chases chickens in joyful chaos. The kettle whistles. Glen’s picking out soft chords on his guitar by the window— his voice warm as sun on old barnwood: "Like a rhinestone cowboy..." It drifts into the air, and Kenny joins in from the porch, mug in hand, singing about the gambler who knew when to hold ‘em. Sigrid rides in just before breakfast, reins in one hand, a bundle of wildflowers in the other. She smells of leather and eucalyptus. Her stories are of winding trails and starry camps, as we sit around a table built by calloused hands and mended with love more than nails. The day is honest work—fences to mend, songs to sing, letters to write in loop...

To My Sons, Seekers of Light in a Forgetting Age — A Father’s Letter from 2025

My beloved sons, As you grow into the fullness of your lives, I want to offer you something more lasting than advice—a light by which to walk, when the world around you grows dim or distracted. When I was your age, I came to America hoping to sit at the feet of giants. I imagined her universities as temples of wisdom, her libraries as cathedrals of memory. I thought I would find in lecture halls what I had glimpsed as a child in Florence, Assisi, Jerusalem—a civilization that remembered who it was. But I arrived in the 1990s to find something else. Professors mocked the past. Students chased credentials. The great books gathered dust, while fashionable ideologies were recited like mantras. I felt out of place—not because I lacked knowledge, but because I hungered for it too deeply. The very soul of the West seemed to have gone silent. And then, I found a voice: Allan Bloom. His Closing of the American Mind said what I could not. Later, Charles Sykes named the betrayal I felt but ...